সাকিব আল মামুন::
এক মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে রিনা বেগম ও মানিক মিয়া দম্পতির সংসার। বড় মেয়ে অনার্স ৩য় বর্ষে অধ্যয়ণরত, ছেলে ডিগ্রি প্রথম বর্ষে। মানিক মিয়া থাকেন প্রবাসে। চলছিল সুন্দর জীবন। স্বপ্ন ছিল আকাশ ছোঁয়া। হঠাৎ পরিবারে নেমে এলো কাল বৈশাখী ঝড়। কেড়ে নিল এই পরিবারের সব স্বপ্ন। জুতা নিয়ে বাকবিতন্ডার জেরে সহপাঠিরা পিঠিয়ে হত্যা করে একমাত্র ছেলেকে। এতে আঁধারে ঢাকা পড়ে সব স্বপ্ন। ছেলে হারাবার শোকে স্ট্রোক করে বিছানায় শয্যাশয়ী রয়েছেন বৃদ্ধ পিতা। ঘটনার ৬ বছর পেরিয়ে গেলেও ছেলে হত্যার বিচার না পাওয়ার গ্লাণি নিয়ে দুঃস্বপ্নের মতো বেঁচে আছে এই পরিবার। বলছিলাম সিলেট কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে তানভীর হোসেন তুহিন (১৯) হত্যাকান্ডের কথা।
দিনটি ২৪ জুলাই ২০১৯! ঘড়িতে সময় দুপুর প্রায় সাড়ে ১২টা, সিলেট কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ঘটে যায় নির্মম এই হত্যাকান্ড। জুতা নিয়ে বাকবিতন্ডার জেরে খুন করা হয় তুহিনকে। বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে তুহিনের স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা শেষ করে পুলিশ অফিসার হবে। কিন্তু ঘাতক সহপাঠিরাই কাল হয়ে দাঁড়ায় তার জীবনে। তুহিনের এ স্বপ্ন পূরণ হতে দেয়নি তারা। নিহত তুহিন গোলাপগঞ্জ উপজেলার হেতিমগঞ্জের কোনাচর দক্ষিণভাগ পলিতাফর গ্রামের মানিক মিয়ার ছেলে।
জানা যায়, তুহিন সিলেট এমসি কলেজের ডিগ্রি প্রথম বর্ষের শির্ক্ষাথী ছিল। সিলেট কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ছয় মাস মেয়াদী বেসিক কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কোর্সে ২৮তম ব্যাচে ভর্তি হয় সে। ঘটনার দিন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রবেশের সময় নির্ধারিত স্থানে জুতা রেখে কম্পিউটার ল্যাবে প্রবেশ করেন তুহিন। ল্যাব থেকে বের হয়ে নির্ধারিত স্থানে জুতা না পেয়ে খোঁজ করতে থাকেন। একপর্যায়ে রাহাত সাদী কামরান নামে অন্য এক প্রশিক্ষণার্থীর পায়ে দেখতে নিজের দাবি করেন। প্রশিক্ষকের মধ্যস্থতায় জুতা ফেরত প্রদান করা হয়। এ ঘটনার রেশ ধরেই পরিকল্পিতভাবে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ভেতরে কেন্টিনের সামনে পিঠিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। তাৎক্ষনিক সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে গুরুতর আহত অবস্থায় উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেয়ার সময় ভৈরব এলাকায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
এ ঘটনায় তুহিনের চাচা নাজিম উদ্দিন বাদী হয়ে ১০ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ২-৩ জনকে আসামি করে মোগলাবাজার থানায় মামলা (নং-৮ তারিখ-২৪/০৭/২০১৯) করেন।
মামলার ৪ আসামিকে গ্রেফতার করা হলেও রহস্যজনক কারনে অধিকাংশকেই গ্রেফতার করা হয়নি। গ্রেফতারকৃত ৪ আসামীই বর্তমানে জামিন নিয়ে পালিয়ে রয়েছেন। ঘটনার ইতিমধ্যে পেরিয়ে গেছে ৬ বছর। এখনো বিচার পায়নি নিহত তুহিনের পরিবার। ঘটনার সাথে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে বিচারের দাবি জানিয়েছে ভুক্তভোগী পরিবার।
এদিকে নিহত তুহিনের পিতা মানিক মিয়া দীর্ঘ ৬ বছর থেকে ছেলে হারাবার শোকে স্ট্রোক করে শয্যাশয়ী রয়েছেন। ঘটনার সময় তিনি সৌদি আরবে ছিলেন। প্রায় সপ্তাহ খানেক পরে দেশে ফিরে আসেন তিনি। একমাত্র ছেলে কে হারিয়ে নিস্তব্দ হয়ে পড়েন। কিছুদিন পর স্ট্রোক করেন। বর্তমানে শয্যাশয়ী অবস্থায় রয়েছেন। তুহিন হত্যাকা-ের সাথে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে ফাঁসির দাবি করেন তিনি।
মা রিনা বেগম বলেন, ‘আমার ফুয়ারে যারা মারিয়া আমার বুক খালি করছে আমি তারার ফাঁসি চাই’। দ্রুত হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি দাবি জানান তিনি।
নিহত তুহিনের বোন ও কাওছারাবাদ কলেজের শিক্ষিকা সাবেরা খানম উর্মী জানান, ‘ছয়বছর পার হয়ে গেল, একমাত্র ভাই হত্যার বিচার আজও পেলাম না। অসুস্থ বাবা কে নিয়ে অনেক চেষ্টা করেছি বিচার পাওয়ার আশায়, কিন্তু তাও পেলাম না। বড় বোন হিসেবে আমি লজ্জিত। ভাই হত্যার বিচার পেলাম না। না পারলাম সব খুনিদের গ্রেফতার করাতে। না পেলাম তার হত্যার বিচার। খুনিরা চোখের সামনে আজও ঘুরে বেড়াচ্ছে। জামিন নিয়ে দিব্বি রয়েছে আসামীরা। তবে আমার ভাই নেই পৃথিবীতে। প্রশাসনের কী কোনো দায়িত্ব নেই? একমাত্র ছেলে হারিয়ে বাবা এখন মৃত্যু শয্যায়। তিনি কী ছেলে হত্যার বিচার দেখে দুনিয়া ত্যাগ করতে পারবেন? বোন হিসেবে আমার একটাই চাওয়া আসামিদের দ্রত গ্রেফতার করে বিচারে আওতায় আনা হোক।’
Tags
গোলাপগঞ্জ